শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১২:১৮ অপরাহ্ন

চোখে ছানিপড়া অক্ষম বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে দুঃখের সাগরে সেতারা

চোখে ছানিপড়া অক্ষম বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে দুঃখের সাগরে সেতারা

ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ

স্বামীর সংসারে এসে কখনই সুখের মুখ দেখেননি বৃদ্ধ সেতারা বেগম। যুগ যুগ ধরে জীবন বাঁচার সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন তিনি। রোদ, বৃষ্টি এবং তীব্র শীতেও দমাতে পারেনি তার পথচলা। দু’মুঠো খাবারের জন্য ১৯৯০ সালের দিকে হাতে নিয়েছিলো ভিক্ষার ঝুলি, কখনো শাক-সবজির দোকান আবার কখনো চায়ের দোকান। কিছুতেই যেন দুঃখ তার পিছু ছাড়ছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন তার সংসারের হাহাকার তীব্র হচ্ছে। নেই খাবার, নেই মাথা গোজার ঠাই, অসুস্থ্য ছানিপড়া স্বামীর জন্য নেই চিকিৎসার খরচ।

অপরদিকে ঋণের বোঝা তার মাথায়। প্রতি সপÍাহে গুনতে হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি। ঝালকাঠির রাজাপুরের শুক্তগড় ইউনিয়নের কেওতা গ্রামের চোখে ছানি পড়া আঃ মালেকের (৮০) স্ত্রী সেতারা বেগম (৬২) তাদের জীবনের কষ্টের কথাগুলো এভাবে বললেন। সেতারা বেগম আরো বলেন, স্বামী মালেক আনুমানিক ৪০ বছর আগে গাছ থেকে পড়ে অসুস্থ হয়। শারিরীক অক্ষম হওয়ায় দিন মজুরী বা অন্য কোন কাজ করতে পারছেন না আঃ মালেক। রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায় তার। অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা না করাতে পারায় সে সুস্থ্য হতে পারেন নি। গত ৪/৫ মাস আগে থেকে মালেকের চোখে সানি হওয়ায় স্বাভাবিক দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন। মালেকের বসত ভিটায় ৩৩ শতাংশ জমি থাকলেও অর্থাভাবে সেখানে ঘর তৈরী করতে পারেননি। বর্তমানে তারা থাকেন উপজেলার বাগরী এলাকার ব্র্যাক অফিসের দক্ষিণ পাশের রুহুল আমিনের পরিত্যক্ত জমিতে এক কক্ষ বিশিষ্ট পলিথিনের চালার ঝুপড়ি ঘরে। বিনা ভাড়ায় ছয় বছর ধরে ওই ঘরেই বসবাস করে আসছেন তারা। সেতারা বেগম আরো জানান, তার সংসারে অর্থাভাব দেখা দিলে প্রথমে তিনি ২/৩ বছর ভিক্ষা করেন। অষ্টম শ্রেণি পাস সেতারা ভিক্ষাবৃত্তি ভালোনা বুঝতে পেরে ভিক্ষা পেশা ছেড়ে দিয়ে দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে খুলনায় চলে যান। সেখানে তিনি অসুস্থ্য স্বামীকে সাথে নিয়ে প্রায় আট বছর শাক-সবজি বিক্রয়ের ব্যবসা করেন। ওই ব্যবসায় সংসার ভালো না চালাতে পেরে সেখান থেকে বরিশালের এসে রুপাতলি এরাকায় একটি চায়ের দোকান দেয়। বরিশালে থাকতে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতেন তারা। বসতভিটায় বাঁশ খুটির একটি ঘরছিলো তাদের। সংসার চালাতে কষ্ট হলে বাড়িতে এসে গ্রামীন ব্যাংক থেকে লোন নেয় সেতারা। সঠিক সময়ে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ঋণের পাল্লা ভারী হতে থাকে। বৃদ্ধি পায় কিস্তি পরিশোধের পরিমাণও। ২০০৭ সালের সিডরে তছনছ হয়ে যায় তাদের ঘরটি। এর পরে ভাড়া থাকেন রাজাপুরের বিভিন্ন স্থানে। ইতোমধ্যে পর পর বিয়ে করেন তাদের দুই ছেলে হুমায়উন কবির ও সুমন। তারা বর্তমানে আলাদা সংসার নিয়ে থাকছেন। তারা দু’ভাই রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বাবা মাকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য নেই তাদের। ছোট ছেলে সুমন অসুস্থ্য বাবা মালেককে তার কাছে নিতে চাইলে মালেক তার স্ত্রী সেতারাকে ছেড়ে শেষ বয়সে কোথাও যেতে চাচ্ছেন না। মালেক চোখে না দেখলেও সেতারা বাজারে শাক-সবজি বিক্রির সময় সেতারার হাত ধরে এসে দোকানের পাশেই চুপ করে বসে থাকেন। অদৃশ্য মায়ার বন্ধনে একে অন্যের পরিপুরক তারা। তারা দু’জন দু’জনার কত যে আপন। ওই ঝুপড়ি ঘরে থেকে সেতারা প্রতিদিন বিকালে গ্রামে গ্রামে হেটে হেটে অল্পদামে হরেক রকম শাক-সবজি কিনে এনে সপ্তাহের সাত দিনই রাজাপুরের হাট ও বাজারে বিক্রি করেন। সেই আয়ের টাকা দিয়ে নিজেদের খাবার, স্বামীর প্রতি মাসে ২/৩ হাজার টাকার ঔষধ ও গ্রামীণ ব্যাংকের সপ্তাহে ১২শ’ টাকা কিস্তি পরিশোধ করেন। গ্রামীণ ব্যাংকে আরো দুই বছর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। তবে সরকারের কোন আর্থিক সহায়তা পেলে বা বিনা সুদে টাকা পেলে একটি দোকান দিয়ে একটু ভালো ভাবে জীবনযাপন করতে পারতেন বলে সেতারা জানান।
অসুস্থ্য আঃ মালেক বলেন, অনেক দৌড়ঝাপ করে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করিয়েছি। তীব্র শীতে খুব কষ্টে ঝুপড়িঘরে থেকেছি, কেউ কোন খোঁজ নেয়নি। পাইনি একটুকরা শীতের বস্ত্র। শুনছি প্রধান মন্ত্রীর পক্ষ থেকে গৃহহীনদের ঘর দেয়া হচ্ছে। আমার সেতারাও স্থানীয় মেম্বর মনিরের কাছে ঘর পাওয়ার জন্য গিয়ে ছিলো। তিনি আমাদের কোন কাগজপত্র নেয়নি। পরে প্রধান মন্ত্রীর দেয়া ঘর পাওয়ার জন্য শুক্তাগড় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবুল হক মৃধার কাছে কাগজপত্র দিয়েছি। আমাদের একটি ঘরের খুবই প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, আমার চোখে সানি পড়েছে। আমি দু’চোখেই ঝাপসা দেখছি। ক্লিনিকের ডাক্তার বলেছেন, অপারেশন করাতে পারলে চোখে দেখতে পাবো। ডাক্তার বলেছেন অপারেশন করাতে প্রায় ৬/৭ হাজার টাকা লাগবে। অর্থাভাবে অপারেশন করাতে পারছিনা।

ধনাঢ্য কোন ব্যক্তি আর্থিক সাহায্য করলে আঃ মালেক ফিরে পেতে পারে তার চোখের দৃষ্টি। মালেক- সেতারা দম্পতিকে কেউ সাহায্য করতে চাইলে তার জন্য সেতারার বিকাশ মোবাইল নাম্বার দেয়া হলো-০১৭৮০২৩৩৯৭১। এ বিষয়ে স্থানীয় মনির মেম্বর বলেন, আমার কাছে মালেক বা সেতারা কখনোই আসেনি। কে কোথায় থাকে কিভাবে জানবো? আমার কাছে আসলে আমি তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করবো। চেয়ারম্যান মুজিবুল হক বলেন, সেতারা-মালেক দম্পতি খুবই অসহয় অবস্থায় আছে। তাদের একটি ঘরের খুব প্রয়োজন। ঘর পাওয়ার জন্য পিআইও অফিসে তাদেরকে একটি দরখস্ত করতে বলা হবে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মোক্তার হোসেন বলেন, বর্তমানে যাদের জমি নাই ও ঘর নাই, তাদেরকে জমিসহ ঘর দেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায় যাদের জমি আছে ঘর নাই, তাদেরকে ঘর দেয়া হবে। মালেকেরতো জমি আছে। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হলে যাচাই বাছাই করে ঘর পাওয়ার উপযুক্ত হলে তাকে ঘর দেয়া হবে।

 

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  




All rights reserved@KathaliaBarta 2023
Design By Rana