রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৭ পূর্বাহ্ন
ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ
লুটপাট আর দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুল হক আকন্দ। একসময় দক্ষিণাঞ্চলের সর্বহারা পার্টির নেতা মজিবুল হক ১৯৯৭ সালে ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর টানা ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনেকটা বিনা ভোটেই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ঝালকাঠি শহরের পালবাড়ী এলাকার জমি বিক্রি করে প্রথমবার নির্বাচন করেন। তারপর লুটপাট আর দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
এর আগে মজিবুল হক সমবায় অধিদপ্তরের পরিদর্শক পদে তিন হাজার চার শ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। পরে দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। চাকরি ছেড়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৮ সালে প্রতিপক্ষ ওলিয়ার রহমান হিরুর দেওয়া খুনের মামলা থেকে রক্ষা পেতে বহুরূপী মজিবুল আকন্দ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আমির হোসেন আমুর আশীর্বাদপুষ্ট হন।
চেয়ারম্যান থাকাকালে পর্যায়ক্রমে দলীয় পদ ও দলের প্রভাব খাটিয়ে ঠিকাদারি কাজ পেতে শুরু করেন। এরপর অবৈধ ড্রেজার মালিক সমিতির সভাপতি পদ দখল করে বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে সুগন্ধা ও বিষখালী নদী থেকে বালু উত্তোলন এবং বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। আমির হোসেন আমু শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরীর নির্ধারিত স্থান বালু ভরাটের টেন্ডার বাগিয়ে নেন। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে নলছিটি উপজেলার ভৈরবপাশা ইউনিয়নে ঢাপড় এলাকায় বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের জমিতে এ বালু ভরাট দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে সুগন্ধা বিষখালী নদী থেকে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। চেয়ারম্যান থাকাকালে নবগ্রাম মডেল স্কুলে ২০ বছর ধরে সভাপতির পদ দখল করে আছেন। একই স্কুলে ১০টি পদের নিয়োগে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ইউনিয়নের জেবুন্নেছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সহ প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন, নৈশপ্রহরী নিয়োগে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করেন।
প্রকল্প স্থানে একটি ডোবা থাকলেও ৪টি বিরাট পুকুর দেখিয়ে এ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ দুর্নীতির সংবাদ ২০১৭ সালে পত্রিকায় প্রকাশের সূত্র ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করে। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় সমন্বিত জেলা কার্যালয় বরিশাল দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. আল আমিন বাদী হয়ে নলছিটি থানায় মামলা করেন। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় এ মামলা করা হয়। মামলায় তৎকালীন বিসিকের প্রকল্প পরিচালক অসীম কুমার ঘোষ, মেসার্স হক ট্রেডার্সের ঠিকাদার নবগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুল হক আকন্দসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়। দুদকের এই মামলায় উল্লেখ করা হয় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা জালিয়াতি অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধমে অধিগ্রহণ করা ১১.৮ একর জমিতে এই ভুয়া বালু ভরাট দেখানো হয়।
আসামিরা বালু ভরাটের স্থানে ৪টি ভুয়া পুকুরে মাটি ভরাট দেখিয়ে প্রকল্পের ৫২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে। পরে আমির হোসেন আমু দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এ মামলা থেকে মজিবুল হক আকন্দসহ আসামিরা অব্যাহতি পান।
শুরুতেই লাখ লাখ টাকার দুর্নীতির কারণে আজ পর্যন্ত বিসিক শিল্পনগরী আলোর মুখ দেখতে পারেনি। তাই এখানে ৭৯টি প্লটের মধ্যে ৫৬টি ফাঁকা পড়ে আছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর মজিবুল হক আকন্দসহ আসামিরা আত্মগোপনে রয়েছন। এ অবস্থায় এলাকাবাসীর দাবি দুদকের করা মামলার পুনরায় সঠিক তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় আনা হোক।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, নবগ্রাম ইউনিয়নের মরহুম আতাহার আলী আকন্দের ছেলে মজিবুল হক চেয়ারম্যান থাকাকালে নবগ্রাম মডেল স্কুলে ২০ বছর ধরে সভাপতির পদ দখল করে আছেন। একই স্কুলে ১০টি পদের নিয়োগে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া ইউনিয়নের জেবুন্নেছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সহ প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন, নৈশপ্রহরী নিয়োগে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করেন।
অভিযোগ রয়েছে বেতরা ও কাফুরকাঠি এলাকার সুকুমার গাঙ্গুলীসহ অনেক হিন্দু পরিবারের প্রায় ৩০ বিঘা সম্পত্তি জবর দখল করেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের টিআর, কাবিখা, এডিবি, রিংস্লাব বরাদ্দ, ওয়ারিশ সনদ, জন্ম নিবন্ধনসহ বিভিন্নভাবে অবৈধ অর্থ আদায় করেন। তার বিরুদ্ধে এলাকায় নারী কেলেঙ্কারির কথা শোনা যায়।
একসময় জমি বিক্রি করে নির্বাচন করা মজিবুল এখন ৬০ লাখ টাকার গাড়িতে চড়েন। ঢাকার শ্যামলীতে ফ্ল্যাট বাড়ি, বরিশালের ঝাউতলায় ১টি চারতলা এবং ১টি একতলা বাড়ি আছে। এ ছাড়া এলাকায় নামে বেনামে প্রায় ৫০ বিঘা জমি রয়েছে বলে জানা যায়।
এলাকায় সরেজমিনে জানা যায়, ১৯৯৭ সনে ইউপি নির্বাচনের সময় মজিবুল হকের নিজ বাড়িতে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে ভাই টিপুসহ পরেশ ও মিজান নামে মোট ৩ জন আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা নিহত হওয়ায় মজিবুলের প্রতিদ্বন্দ্বী অলিউর রহমান হিরুকে ফাঁসাতে হত্যা মামলা করে বলে হিরু জানান।
এলাকাবাসী জানান, ২০০১ সালে বর্তমান নবগ্রাম টেম্পোস্ট্যান্ডে ভাই জুয়েল আকন্দ, মনির আকন্দ, স্ত্রী ও সন্তানরা অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন। এরপর ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিরুকে হারাতে কেন্দ্র দখলে নিতে গুলির ঘটনা ঘটায় মজিবুল হক। বিগত সরকারের আমলে নবগ্রাম ইউনিয়নের প্রতিটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে আমির হোসেন আমুর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। মজিবুল হকের ছোট বোনজামাই আরিফ খান ছিলেন বিগত সরকারের আমলে ঝালকাঠি সদরের উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের অবৈধ অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে সব সময় আতঙ্কিত থাকত এলাকাবাসী।
আত্মগোপনে থাকা মজিবুল হক আকন্দের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে তার র্দুনীতি ও অবৈধ কামাই-রোজগারের বিষয়ে তার মতামত পাওয়া যায়নি। তবে নাম গোপন রাখার শর্তে এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মজিবুল আকন্দ এলাকার একজন জেলাপর্যায়ের ছাত্রদল-যুবদলের নেতার ছত্রছায়ায় আবার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।