রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৬ অপরাহ্ন
ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ
ফুল ফুটতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) এলিট একাডেমিতে। মাত্র ৮ মাসেই কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মো. মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে চলমান বাফুফের এলিট একাডেমি থেকে মিরাজুল ইসলাম নামের একজন ফুটবলার নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব মোহামেডানে।
আরও কয়েকজন আছেন পাইপলাইনে। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের কিছু ক্লাব এরই মধ্যে বাফুফে একাডেমির কয়েকজন খেলোয়াড় নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। বাফুফে অবশ্য বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবে। কেউ ফুটবলার নিতে চাইলেই হুটহাট করে দিয়ে দেওয়া হবে না। মিরাজুল ইসলাম মিরাজের বাড়ি ঝালকাঠি সদরের শেখের হাট গ্রামে।
বাবা-মায়ের ৩ ছেলের মধ্যে সবার ছোট মিরাজ। ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি টান ছিল তার। সেই টান থেকেই বিকেএসপিতে ভর্তি, ঢাকায় তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে খেলা, বাফুফে একাডেমিতে টিকে যাওয়া, চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলা এবং সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগ ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানে নাম লেখানো।
রোববার বিকেলে মোহামেডান ক্লাব চত্বরে বসে বাফুফের এলিট একাডেমি থেকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে সুযোগ পাওয়া প্রথম এই ফুটবলার শোনালেন তার ফুটবলার হওয়ার গল্প। মিরাজের বাবা খলিলুর রহমান দীর্ঘদিন ঝালকাঠি সদর থানা সংলগ্ন এলাকায় বাসাভাড়া করে স্ত্রী ও তিন ছেলে নিয়ে বসবাস করতেন। বাসার পাশে হোটেল ব্যবসা করতেন।
কিন্তু এখন নিজেদের ভিটে-মাটিতে ঘর তুলে বাস করছেন শেখের হাট গ্রামে।বেশ কয়েক বছর হলো অসুস্থ মিরাজের বাবা ঠিকমতো হাঁটতে-চলতে পারেন না। তার মা হেনারা বেগম মরনব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত। মিরাজের বড় ভাই চাকরি করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে, মেঝো ভাই অটোভ্যান চালান। দুই ভাইয়ের আয়ের সঙ্গে মিরাজের মায়ের গহনা যা ছিল বিক্রি করে বাড়িতে ঘর দিয়েছেন।
মেজো ভাইয়ের অটো ভ্যান চালিয়ে যে রোজগার করেন তা দিয়েই চলে মিরাজদের সংসার। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন ঝালকাঠি পৌরসভা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে।চলমান বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছে বাফুফের এলিট একাডেমিও। ১০ ম্যাচে এক হ্যাটট্রিকসহ ১০ গোল করেছেন এই ফরোয়ার্ড। তিনি এখন মোহামেডানের জার্সিতেও গোল দিতে চান। মোহামেডান তাকে দলে নেবে সেটা জেনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি, ‘আমাকে একদিন পাপ্পু (রাশেদ পাপ্পু, একাডেমির কোচ) স্যার বলছিলেন ‘তোমাকে বিপিএল এর একটা ক্লাব ডেকেছে। তবে ক্লাবের নাম বলেননি। আমি ভেবেছিলাম স্যার মজা করছেন। আরেকদিন স্যার বললেন ‘তুমি তো আমাদের ছেড়ে মোহামেডানে চলে যাচ্ছো। তখন বিশ্বাস হলো এবং সাথে সাথে আমি বাড়িতে ফোন করে বাবা ও মাকে জানালাম। দুইজনই খুব খুশি হয়েছেন। মিরাজকে নিতে মোহামেডানকে গুনতে হয়েছে ১০ লাখ টাকা। বাফুফে এই ১০ লাখ টাকার ৪০ শতাংশ মিরাজকে দেবে। এমন এক সময় মিরাজের জীবনের মোড় ঘুরলো যখন তার টাকার খুব প্রয়োজন, ‘টাকার জন্য মায়ের অপারেশন করাতে পারছি না। এই চার লাখ টাকা আমি মায়ের অপারেশনের জন্য দেবো। আরো টাকা লাগবে। মোহামেডানে আসার আগেই অবশ্য মায়ের অপারেশনের কথা বলে বাফুফেতে আবেদন করেছিলাম সহযোগিতার জন্য।’ মিরাজ বিকেএসপির বরিশাল কেন্দ্রের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২০১৭ সালে ভর্তি হয়েছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ঝালকাঠিতে বিকেএসপির ট্রায়াল হয়েছিল। সে ট্রায়ালে টিকে গেলে মিরাজকে নিয়ে আসে সভার বিকেএসপিতে। সেখানে পুনরায় ট্রায়াল দিলে সেখানেও টিকে যান মিরাজ। তাকে নির্বাচন করা হয় বিকেএসপি বরিশাল কেন্দ্রের জন্য। বিকেএসপি বরিশাল কেন্দ্রের কোচ আনোয়ার হোসেন মিরাজকে বলেন ঢাকায় তৃতীয় বিভাগ লিগের একটি ক্লাবে খেলতে হবে। ২০২০ সালে করোনার মধ্যেই মিরাজ চলে আসেন ঢাকায়, যোগ দেয় কিংস্টার ক্লাবে। ওই ক্লাবে খেলা অবস্থায়ই একই বছর বাফুফের এলিট একাডেমির ট্রায়ালে অংশ নিয়ে টিকে যান তিনি। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবলে অংশ নেন মিরাজ। তিনি সুযোগ পান বরিশাল বিভাগীয় দলে। যে দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফাইনালে চট্টগ্রাম বিভাগকে ২-১ গোলে হারিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে মিরাজ গলায় পরেছিলেন পদক।বাফুফের একাডেমি থেকে প্রথম ফুটবলার হিসেবে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবে? কেমন অনভূতি আপনার? ‘অনেক ভালো লাগছে। এখন যদি খেলার সুযোগ পাই তাহলে নিজে যতটুকু পারি তার শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করবো।’ প্রিমিয়ার লিগে সব দলেই বিদেশি আছে। তাদের সঙ্গে খেলতে কোন ভয় পাবেন? ‘প্রশ্নই ওঠে না। আমি কখনও বিদেশি খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেলিনি। তাতে সমস্যা নেই। ওরা আমার চেয়ে লম্বায় ও শক্তিতে হয়তো এগিয়ে থাকবে। কিন্তু আমাকে খেলতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। ফুটবল যে বুদ্ধিরও খেলা’- বলছিলেন মিরাজ। দেশে মিরাজের কোনো পছন্দের খেলোয়াড় নেই। তিনি মেসি, নেইমার ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ভক্ত। তিনজনের মধ্যে যদিও তিনি মেসিকেই সেরা মনে করেন। মিরাজের এখন একটাই লক্ষ্য মোহামেডানের খেলার সুযোগ পেলে গোল করা, ‘আমাকে যে উদ্দেশ্যে মোহামেডান নিয়েছে আমি চেষ্টা করবো গোল করে তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে। মোহামেডানে ভালো খেলতে পারলে আমার পরের লক্ষ্য হবে জাতীয় দলে খেলা।