ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ
ঝালকাঠি সদর উপজেলার নথুল্লাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার নৃত্য ইভেন্টে পুর্ব প্রস্তুতি চলাকালে প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন ৮ জন ছাত্রীকে পিটিয়ে আহত করেছে।ছাত্রীদের বেত্রাঘাত করার অভিযোগে বিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ অন্য শিক্ষার্থীরা ও উত্তেজিত জনতা প্রধান শিক্ষকে বেধড়ক পিটিয়ে স্কুলের লাইব্রেরী কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখে। বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারী) দুপুরে উপজেলার নথুল্লাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে।
বিগত ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামীলীগের টানা ১৫ বছর একই বিদ্যালয়ে কর্মরত নানা দুর্নীতিতে লিপ্ত প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেনকে অবরুদ্ধ করার খবরে স্কুল কম্পাউন্ডে ছুটে আশপাশের স্থানীয় জনতা এবং ছাত্র/ছাত্রীদের অভিভাবকরা। তারা সকলে সেখানে জড়ো হয়ে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ ও বিচারের দাবিতে শ্লোগান ও বিক্ষোভ করতে থাকে।
এঅবস্থায় ঝালকাঠি সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলামসহ সদর থানা পুলিশের একটি দল বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী কক্ষ থেকে প্রধান শিক্ষককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে প্রধান শিক্ষককে বহনকারী গাড়ি বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয়রা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ম্যাজিষ্ট্রেটের গাড়ির মধ্যে বসেই পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করেন প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন। এর পরেই সড়ক ছেড়ে দেয় আন্দোলনরতরা।
এদিকে প্রধান শিক্ষকের পিটুনিতে আহত ৮ শিক্ষার্থী ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে চারজনকে ভর্তি রেখে বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা সবাই সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ছাত্রী। অপরদিকে আহত প্রধান শিক্ষককে ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা।
এলাকাবাসী জানায়, সম্প্রতি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন নিয়ে স্থানীয় বিএনপি–সমর্থিত নেতা–কর্মীর সঙ্গে প্রধান শিক্ষক মো. তোফাজ্জেল হোসনের বিরোধ চলছিল। কমিটির সাবেক সদস্যরা আওয়ামীপন্থী থাকায় তারা এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেন। তাই জেলা প্রশাসন ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস নতুন করে কমিটি করার নির্দেশনা দেয়। প্রধান শিক্ষক আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে সভাপতির নাম প্রস্তাব করে জেলা প্রশাসকের কাছে সম্প্রতি কমিটি দাখিল করে বলে অভিযোগ। এ নিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবী আল আমিন হাওলাদারের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। গতকাল বুধবার প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমানের কাছে ছাত্র ও অভিভাবকেরা একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এতে প্রধান শিক্ষক কিছুটা ক্ষুব্ধ হন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান উপলক্ষে ছাত্রীদের অংশগ্রহণে নাচ-গানের মহড়া চলছিল। দুপুরে প্রধান শিক্ষক মো. তোফাজ্জেল হোসেন বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে নাচের মহড়ায় ভুল করার অজুহাতে ৮ম শ্রেণীর মোসা জান্নাতী ও ইসরাত জাহান রুমকী, ৯ম শ্রেণীর জান্নাতী আক্তার, ১০ম শ্রেণীর মোসা সিপু আক্তার, মোসা আয়সা মনি ও মোসা সুমা আক্তারসহ আটজন ছাত্রীকে বেত দিয়ে পেটান। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কয়েকজন ছাত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে শিক্ষার্থীদের চিৎকার শুনে অভিভাবক ও এলাকাবাসী ছুটে আসেন।
নথুল্লাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সাবেক সেনা সদস্য মো. সাব্বির হোসেন জানান, বিদ্যালয়টির ম্যনেজিং কমিটি গঠন নিয়ে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রুপিং চলছিলো। প্রধান শিক্ষক একটি গ্রুপের মদদদাতা ছিলেন। তিনি মিজানুর রহমান বাদল নামের একজনকে এডহক কমিটির আহবায়ক করে একটি কমিটি গোপনে দাখিল করেছে। এটা জানাজানি হলে অভিভাবকরা ডিসির কাছে লিখিত আপত্তি দেয়। যা প্রধান শিক্ষক বৃহস্পতিবার সকালে জানতে পেরেছে। আর সেই থেকেই তার মাথা গরম হয়। সেই রাগ ঝেড়েছে ছাত্রীদের পিটিয়ে।
প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন কর্তৃক দাখিলকৃত এডহক কমিটির বিপক্ষে শিক্ষার্থী/অভিভাবক ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের পক্ষে মো. হাফিজুর রহমান লিটু লস্কর স্বাক্ষরিত ঐ আপত্তি আপত্তিপত্রের একটি কপি সংগ্রহ করেছে গণমাধ্যম কর্মীরা।
তাতে লেখা রয়েছে, “প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের মতামত উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামত শিক্ষক নিয়োগ, অতিরিক্ত ফি আদায়, জন্ম নিবন্ধনের সংশোধনের কথা বলে টাকা আদায়, ফেল করা ছাত্রদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নিয়ে পরিক্ষায় অংশ গ্রহন করার সুযোগ দেয়া, বহু লোকের নিকট হইতে নিজ নামিয় চেক প্রদান করে ধার
হিসেবে টাকা এনে টাকা পরিশোধ না করে স্কুলের স্বার্থে খরচ করেছে বলে ধারের টাকা পরিশোধ না করে মানুষের সাথে প্রতারনা করা, স্কুলের গাছ বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ সহ বিভিন্ন প্রকার দূর্নীতি করে আসছে।”
আরে উল্লেখ রয়েছে, “প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতারনা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতে নথুল্লাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির বিষয়ে জরুরী বৈঠক হয়। বৈঠকে ছাত্র/ অভিভাবক ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের মতামতের ভিত্তিতে এ্যাড. আল আমিন (এ.পি.পি) কে সভাপতি মনোনিত করে এবং হাফিজুর রহমান লিটু লস্করকে অভিভাবক সদস্য হিসেবে মনোনিত করে সিদ্ধান্ত গৃহীতি হয়। ঐ সিদ্ধান্তে প্রধান শিক্ষক একমত পোষন করে স্বাক্ষর প্রদান করেন এবং উপস্থিত অভিভাবকগণও স্বাক্ষর প্রদান করেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ, শিক্ষার্থী, অভিভাবকগনের মতামত উপেক্ষা করর, অবৈধভাবে আওয়ামীলীগ সমর্থীত মো. মিজানুর রহমান (বাদল) কে এডহক কমিটির আহবায়ক মনোনিত করে একটি পকেট কমিটি দাখিল করেছেন।”
তার দেয়া ঐ কমিটি যাতে অনুমোদন না পায় তার প্রেক্ষিতে এলাকাবাসী ও অভিভাবকগন এবং স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে এই আপত্তিপত্র দাখিল করা হয়।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সুলতানা সোনিয়া বলেন, শিক্ষার্থীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেছে। ওদের প্যানিক কেটে গেলে সুস্থ হয়ে যাবে।
বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির আহত ছাত্রী জান্নাতী বেগম বলে, আমাদের নাচের মহড়া চলা অবস্থায় প্রধান শিক্ষক স্যার ভুল হওয়ার অজুহাতে হঠাৎ বেত দিয়ে পেটানো শুরু করেন। এতে অনেক ছাত্রী আহত হয়। অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ঝালকাঠি বারের বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির পদপ্রত্যাশী আল আমিন হাওলাদার বলেন, প্রধান শিক্ষক স্বেচ্ছাচারী হয়ে আওয়ামীপন্থী লোক দিয়ে বিদ্যালয়ের কমিটি করতে চায়। তাঁর নামে একাধিক মামলা রয়েছে। জনতা তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে।
এবিষয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ছাত্রীদের পেটানোর ঘটনায় উত্তেজিত জনতা প্রধান শিক্ষককে পিটিয়ে আহত করে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এ ঘটনার তদন্ত করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সাইফুল ইসলাম প্রধান শিক্ষক মো. তোফাজ্জেল হোসনকে আহত অবস্থায় নিজের গাড়িতে করে প্রথমে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। পরে তাঁকে চিকিৎসকেরা সেখান থেকে বরিশাল শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। এ সময় প্রধান শিক্ষক মো. তোফাজ্জেল হোসন বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রের শিকার। আমাকে অন্যায়ভাবে লাঞ্ছিত করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।