মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১১:১৩ অপরাহ্ন

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন : মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের পথে শিক্ষকদের বেতনের সংস্কার অপরিহার্য।

মানসম্মত শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং এর ভিত্তিপ্রস্তর হলো প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তি তৈরি করেন। তবে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং আর্থিক মর্যাদা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত নিম্ন, যা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের পথে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।  শিক্ষকতা পেশাটি কেবল একটি চাকরি নয়, এটি একটি মহান ব্রত। কিন্তু যখন এই ব্রত পালনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা যায় না, তখন মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা এই পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত হন। ফলস্বরূপ, শিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে ১১,০০০ টাকা মুল বেতন পান । ডলারে হিসেব করলে বাংলাদেশের একজন প্রাথমিক শিক্ষকের মাসিক গড় বেতন প্রায় ১৭০.০২ মার্কিন ডলার, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম । উচ্চমূল্যের বাজারে এই সামান্য বেতন দিয়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে মানসম্মত জীবনযাপন করা এবং পরিবার চালানো অত্যন্ত কঠিন। এই বৈসাদৃশ্য শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান এবং পেশাগত সন্তুষ্টির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

#বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন  $170.02 যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের সাথে  দক্ষিণ এশিয়ার প্রাথমিক শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতনের তুলনা করলে দেখা যায় মালদ্বীপের প্রাথমিক শিক্ষকদের মাসিক বেতন $953.13  যা বাংলাদেশি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি। নেপালের প্রাথমিক শিক্ষকদের মাসিক বেতন  $467.45 যা প্রায় ২.৭৫ গুণ বেশি। ভুটানের  $284.64 যা প্রায় ২ গুণের চেয়ে একটু কম। ভারতের  $284.64 যা প্রায় ১.৬৭ গুণ বেশি। শ্রীলঙ্কার $250.44 যা প্রায় ১.৪৭ গুণ বেশি। পাকিস্তানের $206.07 যা প্রায় ১.২১ গুণ বেশি।

#শিক্ষকদের নিম্ন বেতন কেবল তাদের ব্যক্তিগত আর্থিক সমস্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানকে প্রভাবিত করে।  কম বেতনের কারণে দেশের মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত হন । যখন অন্যান্য পেশায় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা থাকে, তখন শিক্ষকতা পেশাটি আর আকর্ষণীয় থাকে না। ফলে, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক সময়ই কাঙ্ক্ষিত মানের যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না, যা শিক্ষার ভিত্তিকেই দুর্বল করে দেয়।

#আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক মর্যাদার অভাব শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। একজন শিক্ষক যখন তার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সংগ্রাম করেন, তখন শ্রেণীকক্ষে তার মনোযোগ ও কর্মস্পৃহা কমে যাওয়া স্বাভাবিক । শিক্ষকদের এই নিম্ন মনোবল সরাসরি শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
#জীবনধারণের তাগিদে অনেক শিক্ষককে ব্যাংক থেকে  লোন নিতে হয় । মনে রাখতে হবে এই লোন তারা কোনে বিলাসিতার জন্য নেয় না, নেয় তাদের মৌলিক চাহিদা পুরণ করার জন্য। লোনের কারণে অনেক শিক্ষকের চাকুরি চলে যায়। বেশিদিন হয় নাই কাঠালিয়ার একজন শিক্ষক লোনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে মান সম্মানের ভয়ে পারি দিয়েছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত না থাকার জন্য তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সরকারি চাকরিটা চলে গেল। এভাবে অগনিত শিক্ষক আর্থিক দিনতা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে নিয়মিত পাঠদান করে। এটি শিক্ষকদের পেশাগত নৈতিকতা এবং শ্রেণীকক্ষে তাদের পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করে।

#ইউনেস্কো (UNESCO) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মূল্যায়ন করেছে যে, বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য যথেষ্ট নয় । গবেষণা বারবার দেখিয়েছে যে, শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত বেতন কাঠামো তাদের পেশাগত জীবনে সন্তুষ্টি এবং অনুপ্রেরণা যোগায়, যা শেষ পর্যন্ত শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হয় ।

#মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উপযুক্ত বেতনের প্রয়োজনীয়তাঃ

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
একটি সম্মানজনক বেতন কাঠামো মেধাবী ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করবে। এটি কেবল নতুনদের আকর্ষণ করবে না, বরং বর্তমানে কর্মরত যোগ্য শিক্ষকদেরও পেশায় দীর্ঘমেয়াদী ধরে রাখতে সাহায্য করবে, যা শিক্ষাব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনবে।

#বেতন বৃদ্ধি শিক্ষকতা পেশার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে। যখন একজন শিক্ষক আর্থিকভাবে সচ্ছল হন, তখন সমাজে তার সম্মান বাড়ে এবং তিনি আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

#আর্থিক নিরাপত্তা শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে (যেমন উন্নত প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ) মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করবে। তারা নিজেদের উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হবেন, যার ফলে শ্রেণীকক্ষে উন্নত পাঠদান বাস্তবায়ন হবে।

#জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG 4) অর্জনের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এবং ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত বেতন নিশ্চিত করা এই লক্ষ্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

পরিশেষে বলা যায় যে শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি মানেই শিক্ষার মান বৃদ্ধি, আর শিক্ষার মান বৃদ্ধি মানেই জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিশ্চিত করা। শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি কেবল একটি স্বপ্নই থেকে যাবে। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দ্রুত এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং শিক্ষকদের জন্য একটি সম্মানজনক ১০ম গ্রেডের  বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা উচিত।

লেখক:
মোঃ শফিকুল ইসলাম
সহকারী শিক্ষক
কাঠালিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

কাঠালিয়া বার্তা’য় বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন : মোবাইলঃ 01774937755 অথবা ই-মেইল: kathaliabarta.com












All rights reserved@KathaliaBarta 2016-2025
Design By Rana